এই অধ্যায় শেষে শিক্ষার্থীরা নিচের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারবে-
অর্থ—অর্থাৎ কোনো কিছুকে ধাক্কা দেওয়া, টানা বা আকর্ষণ করাকে বুঝে নেব।
তোমাদের দৈনিন্দন জীবনে তোমরা সেটা ঘটতে দেখোনা বলে নিশ্চয়ই সবার মনে হচ্ছে, এটি কীভাবে সম্ভব! তোমরা যারা মেঝেতে একটা মার্বেল কিংবা একটি খেলনা গাড়ি গড়িয়ে দিয়েছ, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ যে গাড়িটি মোটেই সরলরেখার সমাবেগে অনন্তকাল ধরে চলছে না। আগে হোক কিংবা পরে হোক মার্বেল কিংবা খেলনা গাড়ি থেমে গেছে। তার কারণ হচ্ছে, মেঝের সঙ্গে ঘর্ষণ কিংবা বাতাসের ঘর্ষণ। তুমি যদি সত্যি সত্যি ঘর্ষণের বল কমিয়ে আনতে পারতে, তাহলে অবাক হয়ে দেখতে মার্বেল কিংবা খেলনা গাড়ি থেমে না গিয়ে চলছে তো চলছেই।
তোমরা যারা সাইকেল চালাও তারা সবাই নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ যে চালানো শুরু করার পর প্রথমে একটু পরিশ্রম করে প্যাডেলে চাপ দিয়ে সাইকেলের বেগটি বাড়াতে হয়। একবার সাইকেলের বেগ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে গেলে প্যাডেল না করলেও সাইকেল একই বেগে যেতে থাকে। তখন ধর্ষণের কারণে কমে আসা বেগটুকু ধরে রাখার জন্য মাঝে মাঝে প্যাডেলে চাপ দিয়েই সাইকেল চালানো যায়।
যারা গাড়ি, বাস বা ট্রাক চালায় তাদের সঙ্গে কথা বললেও তোমরা জানতে পারবে যে তারা যখন প্রথম স্থির অবস্থা থেকে গাড়ির বেগ বাড়াতে থাকে, তখন ইঞ্জিনের অনেক পেট্রোল ডিজেল কিংবা গ্যাস খরচ করতে হয়। যখন গাড়ি, ট্রাক বা বাসের গতিবেগ তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে যায়, তখন তাদেরকে সেই। গতিবেগকে ধরে রাখার জন্য খুবই অল্প পেট্রোল, ডিজেল বা গ্যাস খরচ করতে হয়। কাজেই তোমরা গভির একটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশেষত্বের কথা জেনে গেছ আর সেটি হচ্ছে:
কোনো কিছু সরলরেখার সমান রেখে যেতে থাকলে সেটি সেভাবেই যেতে থাকবে বেগ বাড়াতে কিংবা কমাতে হলে, কিংবা বেগের দিকের পরিবর্তন করতে হলে বল। প্রয়োগ করতে হবে।
তোমাকে যদি কেউ বলে, তুমি মেঝেতে একটা মার্বেল এমনভাবে গড়িয়ে দেবে যেন সেটা সোজা না গিয়ে বাঁকা একটা গতিপথে যায়, তাহলে তুমি দেখবে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তুমি যতই চেষ্টা করো মার্বেলটা সোজা পথে যাবে। তোমরা নিশ্চয়ই এখন কারণটা নিজেরাই বুঝে গেছ, মার্কেলটাকে বাঁকা পথে পাঠাতে হলে তার ওপর বল প্রয়োগ করতে হবে, কিন্তু ফাঁকা মেঝেতে মার্বেলটা গড়িয়ে দেওয়ার পর তার ওপর কোনো কিছু বল প্রয়োগ করতে পারে না।
তবে একটা বস্তুকে বক্রগতিতে চালানোর একটা খুব সহজ পদ্ধতি আছে। তুমি যদি কোনো কিছুকে ছবিতে যেভাবে দেখানো হয়েছে সেভাবে ছুড়ে দাও, তাহলে দেখবে, সেটা সোজা সরল পথে না গিয়ে একটা বাঁকা পথে যাচ্ছে অর্থাৎ তার মধ্যে একটা বক্রগতি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষণে তার কারণটাও বুঝতে পারছ। তুমি যখন কোনো কিছু ছড়ে দাও তখন তার উপর মধ্যাকর্ষণ বল নিচের দিকে কাজ করে এবং সেই কারণে বস্তুটা সোজা সরল পথে না গিয়ে একটা বাঁকা পথে যায়।
বজ্রগতির আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ঘূর্ণন গতি। তুমি একটা ছোট পাথরকে সুতা দিয়ে বেঁধে মাথার উপর দিয়ে ঘোরাতে পারো, এটা ঘূর্ণন গতির একটা চমৎকার উদাহরণ। পাথরটি যেহেতু ঘোরার জন্য প্রতি মুহূর্তে দিক পরিবর্তন করছে তার অর্থ নিশ্চয়ই তার ওপর বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে। সেই বলটি কোথা থেকে আসছে?
সুতা দিয়ে পাথরটাকে বেঁধে তুমি নিজেই পাথরটাকে টেনে ধরে রেখে তার ওপর কেন্দ্রের দিকে বল প্রয়োগ করছ বলে পাথরটা তোমাকে ঘিরে ঘুরছে। তুমি যদি হঠাৎ সুতাটা ছেড়ে দাও, তাহলে পাথরটার ওপর আর কোনো বল থাকবে না বলে সেটা সোজা ছুটে যাবে, সেটা কিন্তু আর বাঁকাভাবে যাবে না।
তোমরা কি এ রকম ঘূর্ণন গতির আর কোনো উদাহরণ দিতে পারবে? একটি উদাহরণ তোমরা
সবাই দেখেছ, সেটি হচ্ছে আকাশের চাঁদ। আমরা সবাই আকাশের চাঁদকে সরু একটা রূপ থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে পূর্ণিমার চাঁদ হতে দেখি, তারপর আবার সেটি ধীরে ধীরে সরু হতে হতে অমাবস্যায় পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রতি ২৯ দিনে একবার করে এই ব্যাপারটি ঘটে, কারণ পুরো পৃথিবীকে একবার পুরোপুরি ঘুরে আসতে চাঁদটির ২৯ দিন সময় লাগে! চাঁদটি সরু দেখাবে নাকি পূর্ণিমার ভরাট চাঁদ দেখাবে, সেটা নির্ভর করে সূর্যের তুলনায় সেটি পৃথিবীর কোন দিকে আছে তার ওপর। পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদের এই ঘূর্ণন গতিটি চলমান থাকতে পারে কারণ, পৃথিবী তার মধ্যাকর্ষণ বল দিয়ে চাঁদকে নিজের দিকে টেনে রাখে—ঠিক যে রকম তুমি পাথরের টুকরাকে সুতা দিয়ে বেঁধে তোমার কাছে টেনে রেখেছিলো ঠিক একই ভাবে পৃথিবী সূর্যের আকর্ষণের কারণে সূর্যকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। আবার সূর্য আমাদের গ্যালাক্সিতে ছায়াপথের কেন্দ্রে থাকা বিশাল ব্ল্যাকহোলের আকর্ষণে তার কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরতে থাকে।
তুমি যদি সব সময় তোমার চোখ খোলা রাখো তাহলে আমাদের চারপাশে ঘূর্ণন গতির অনেক উদাহরণ খুঁজে পাবে। এখন থেকে যখনই তুমি এ রকম গতি দেখতে পাবে, সেটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে। এর মধ্যে অনেক মজার বিষয় লুকিয়ে থাকে।
উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায় তুমি যদি একটা ৩০ cm সুতার সঙ্গে ছোট একটা পাথর বেঁধে ঝুলিয়ে দাও, তাহলে দেখবে সেটি মোটামুটি এক সেকেন্ডে ডান থেকে বামে গিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে। তুমি জোরে বা আস্তে দুলিয়ে দিয়ে যত চেষ্টাই করো, সেটি সবসময় পুরো একবার দুলতে এক সেকেন্ড সময় নেবে। যদি সুতার দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন করো শুধু তাহলে তুমি দোলনকালটার পরিবর্তন করতে পারবে।
তোমরা যখন উপরের ক্লাসে যাবে তখন পর্যায়বৃত্ত গতি সম্পর্কে আরও বিষয় জানতে পারবে। আপাতত তুমি শুধু এর গুরুত্বপূর্ণ অংশটা মনে রেখ, যেহেতু পর্যায়বৃত্ত গতিতে একটি বস্তুর গতির পরিবর্তন হয়, কাজেই তার অর্থ যে বলটি বস্তুকে গতিশীল করছে, সেই বলটিরও দিক পরিবর্তন হয়।
তোমরা কি উপরের উদাহরণগুলো বিশ্লেষণ করে বস্তুর ওপর কী বা কাজ করছে এবং কীভাবে দিক পরিবর্তন করছে, সেটি অনুমান করতে পারবে?
একটি নির্দিষ্ট সময় একটি বস্তু কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেছে, সেটি থেকে আমরা বস্তুটির বেগ পরিমাপ করতে থাকি। একটা গাড়ি যদি এক ঘণ্টায় ৩৬ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে তাহলে তার বেগ v আমরা ইচ্ছা করলে মিটার এবং সেকেন্ডে প্রকাশ করতে পারি।
তোমরা এর মধ্যে জেনে গেছে যে চলমান একটি বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করা না হলে বস্তুটি সমবেগে সরলরেখায় যেতে থাকে। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি, একটা বস্তুর বেগ পরিবর্তন করতে হলে বল প্রয়োগ করতে হয়। তোমরা এটাও জেনে গেছ, বস্তুর বেগ দুইভাবে পরিবর্তন করা যায়। যদি সরলরেখায় গতিশীল হয় তাহলে বস্তুর বেগ বাড়িয়ে বা কমিয়ে এবং গতিশীল বস্তুর দিক যদি পরিবর্তন হয়, তাহলেও তার বেগের পরিবর্তন হয়।
বস্তুর বেগের পরিবর্তন করার জন্য যেহেতু বল প্রয়োগ করতে হয়, তাই বলকে ভালোভাবে বোঝার জন্য বেগের পরিবর্তন খুব ভালোভাবে বুঝতে হয়। সে জন্য বেগের পরিবর্তনের জন্য আলাদা একটা নামকরণ হয়েছে, সেটি হচ্ছে ত্বরণ। যখনই বেগের পরিবর্তন হয়, আমরা বলে থাকি ত্বরণ হয়েছে। সরলরেখার গতিশীল বস্তুর ত্বরণ কীভাবে পরিমাপ করা যায় আমরা এখন সেটি দেখব। দিক পরিবর্তন হলে কিংবা বক্ররেখায় গতিশীল বস্তুর ত্বরণ আমরা উপরের ক্লাসে জেনে নেব।
কতটুকু সময়ে কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করছে, সেখান থেকে আমরা যেরকম বেগ বের করেছি ঠিক সেইভাবে কতটুকু সময়ে কতটুকু বেগের পরিবর্তন হয়েছে, সেখান থেকে আমরা ত্বরণ বের করতে পারি। অর্থাৎ,
ত্বরণ = শেষবেগ-আদিবেগ/ অতিক্রান্ত সময়
ত্বরণ যদি নেগেটিভ হয়, তাহলে বুঝতে হবে গতিবেগ আসলে কমে যাচ্ছে। কমে যাওয়া বোঝানোর জন্য অনেক সময় আমরা মন্দন কথাটা ব্যবহার করি।
অনুশীলনী
১। বইয়ের উদাহরণের বাইরে তুমি কি কোনো সরল, বক্র, ঘূর্ণন এবং পর্যাবৃত্ত গতির উদাহরণ দিতে পারবে?
২। পৃথিবীর ব্যাসার্ধ যদি ৬০০০ কিমি হয় তাহলে প্লেনে করে সারা পৃথিবী ঘুরে আসতে কত সময়য় লাগবে? রকেটে করে?
আরও দেখুন...